স্বদেশ ডেস্ক:
করোনার বিস্তার রোধে সরকারের ১১ দফা নির্দেশনা অনুযায়ী আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে গণপরিবহনে অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুরোদমে খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন কীভাবে সম্ভব- সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কয়েক দিন আগেই গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে পরিবহন মালিকরা জানিয়ে দিয়েছেন, অর্ধেক যাত্রী বহন করতে হলে তারা ভাড়া বাড়াবেন। যদি তাই হয়, তা হলে আরেক দফা বাড়তি ভাড়ার বোঝা বহন করতে হবে যাত্রীদের। কর্মদিবসের সকালে ও
বিকালে অফিস শুরু এবং ছুটির সময়ে রাজধানীর গণপরিবহনে আসন পাওয়াই দুষ্কর। যাত্রার ৫ দিন আগে বিক্রি শুরুর হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফুরিয়ে যায় ট্রেনের টিকিট। এমন বাস্তবতায় সব খোলা রেখে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনে যানবাহনের সংকট হবে নিশ্চিতভাবেই। ফলে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে বাসে ভিড় কমাতে অর্ধেক আসন খালি রাখার সিদ্ধান্ত ভালো। কিন্তু কীভাবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে, তা বোধগম্য নয়। আগেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে মিরপুর-১০ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে ভাড়া ছিল ২০ টাকা। এখন ২৬ টাকা হয়েছে। অর্ধেক আসন খালি রাখার কারণে ৫০ শতাংশ বাড়লে ভাড়া হবে ৩৯ টাকা। অর্থাৎ ভাড়া দুই মাসের ব্যবধানে ™ি^গুণ হয়ে যাবে।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পরিচালক (ট্রাফিক) রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন ও ভাড়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অন্যান্য গণপরিবহন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে এক-দুই দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, বাসে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সরকারি নির্দেশনা কীভাবে কার্যকর হবে, এ বিষয়ে আজ (বুধবার) মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভাড়া বৃদ্ধি বৈঠকের উদ্দেশ্য নয়। বিআরটিএর কাছে সবার আগে জনস্বার্থ। বৈঠকে যদি ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব আসে, তা যৌক্তিক হলে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আগেরবার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলার শর্ত মানতে মালিকরা ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। পরে মন্ত্রণালয় ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছিল। পরিবহন মালিক সূত্র জানিয়েছে, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলতে অন্তত ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়াতে চান তারা।
আগামী শনিবার থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলবে। তবে ভাড়া বাড়বে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী।
বাস কীভাবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলবে, ভাড়া কত বাড়বে- আজ বুধবার বেলা আড়াইটায় বাস মালিকদের সঙ্গে পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ রোধের ‘লকডাউনে’ প্রথম দফায় ৬৮ দিন বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ ছিল। সে বছরের ১ জুন থেকে আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। মালিকদের প্রস্তাবে সেবার বাস ও লঞ্চের ভাড়া ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। গত বছর দুই দফার ‘লকডাউনের’ পরও একই হারে ভাড়া বাড়িয়ে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলেছিল বাস-লঞ্চ।
ডিজেলের দাম লিটারে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ায় গত ৮ নভেম্বর বাসের ভাড়া ২৭ থেকে ২৯ শতাংশ বেড়েছে। লঞ্চে ভাড়া ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলার শর্তের কারণে দুই মাসের ব্যবধানে ফের ভাড়া বাড়লে তা যাত্রীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আগেও অর্ধেক সিট খালি রাখার শর্ত মানা হয়নি। কিন্তু ৬০ শতাংশের পরিবর্তে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এবারও তাই হতে পারে। এর চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় কঠোর জোর দিয়ে আসনের সমানসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেওয়া উচিত।’
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব মালিকরা দেননি। তবে অর্ধেক সিট খালি রাখলে মালিকদের লোকসান হবে। লোকসান পোষাতে যতটা ভাড়া না বাড়ালেই নয়, ততটা বাড়াতে হবে। যাত্রী, মালিক, শ্রমিক- সবার স্বার্থ রক্ষা করে ভাড়া নির্ধারণ করা হোক।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব কিছু খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক আসন খালি রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। এতে শুধু ভাড়া বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, যানবাহন সংকটের কারণে বাসযাত্রী বোঝাই হয়ে চলছে।’
রাজধানী ও আশপাশের রুটে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা সোয়া ছয় হাজার। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার হাজার বাস চলাচল করে, যা সকালে ও বিকালে ‘পিক আওয়ারে’ পর্যাপ্ত নয়। লোকাল হিসেবে চলা বাসে দাঁড়ানোসহ আসনের দেড় থেকে দুগুণ যাত্রী থাকে। অর্ধেক আসন খালি রাখলে পিক আওয়ারে তিন থেকে চারগুণ বাস লাগবে। ফলে যানবাহন সংকট হবে নিশ্চিত।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্ধেক সিট খালি রাখলে যান সংকট কীভাবে দূর করা হবে, তার নির্দেশনা নেই। অর্ধেক সিট খালি রাখলে ভাড়া বাড়াতে হবে। যাত্রী ও মালিক- উভয় পক্ষই করোনার কারণে আর্থিকভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। তাই যাত্রীর ওপর বাড়তি ভাড়ার বোঝা না চাপিয়ে সরকারকেই প্রণোদনা দিতে হবে।
বাস-ট্রেন-লঞ্চে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের আহ্বান : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বাস, ট্রেন ও লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী বহনের নামে ভাড়া নৈরাজ্য ও সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অতিরিক্ত যাত্রী বহন ঠেকাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কঠোর অবস্থানে থাকারও আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক সংগঠনটি।
গতকাল মঙ্গলবার এক যুক্ত বিবৃতিতে জাতীয় কমিটির সভাপতি মো. শহীদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন করে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার সব ধরনের গণপরিবহনে ১৩ জানুয়ারি থেকে আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন এবং মুখে মাস্ক পরার নির্দেশনা জারি করেছে। এ ছাড়া চালক ও চালকের সহকারীসহ সব পরিবহনকর্মীকে দুই ডোজ করোনাপ্রতিরোধী টিকা গ্রহণকারী হতে হবে।
তবে নিকট অতীতে দেখা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে সরকার এমন নির্দেশনা দিলেও সব গণপরিবহনই অতিরিক্ত (৫০ শতাংশের বেশি) যাত্রী, এমনকি মাস্কবিহীন যাত্রীদেরও বহন করেছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বাস ও টেম্পোতে পরিবহনকর্মীরা ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করেছেন।